ধানের ক্ষেতে সবজি চাষ করে সহজেই একটি জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়। সঠিক পদ্ধতি জানা থাকলে ধানের উৎপাদন ব্যাহত না করেই এক বিঘা জমি থেকে কয়েক মণ সবজি উৎপাদন করা সম্ভব। অনেকে মনে করেন, অতিরিক্ত রসের কারণে ধানের ক্ষেতে সবজি গাছ মরে যাবে, লতা জাতীয় সবজি ছড়িয়ে গিয়ে ছায়া তৈরির করার কারণে ধানের ফলন কমে যাবে, সবজি গাছ বাঁচলেও তেমন ফলন হবে না ইত্যাদি। কিন্তু সবজির সঠিক জাত নির্বাচন, সঠিক নিয়মে মাদা বা দরা বা থরা তৈরি এবং মাচা তৈরি করতে জানলে খুব সহজেই প্রায় বিনা খরচে প্রচুর সবজি উৎপাদন করা সম্ভব।
যেসব সবজি চাষ করা যায়
ধানের ক্ষেতে আইলে বা ক্ষেতের ভেতরে দুই জায়গাতেই সবজি চাষ করা যায়। এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করতে চাইলে অবশ্যই হাইব্রিড জাত বেছে নিতে হবে। কারণ এসব জাতের সবজির বান বা লতা খুব বেশি বড় হয় না কিন্তু ফল ধরে বেশি। স্থানীয় জাতের লতা বেশি বড় হয় কিন্তু ফল কম পাওয়া যায়। তাছাড়া লতা বেশি বড় হলে বড় মাচা দিতে হবে, এতে ধানে যথেষ্ট রোদ পড়বে না। তাতে ধানের ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ধানের ক্ষেতে চাষ করার জন্য উপযুক্ত সবজি হলো: লাউ, কুমড়া, চিচিঙ্গা, ধুন্দল, করলা, শিম।
চাষ পদ্ধতি
ধানের ক্ষেতে দুই ভাবে সবজি চাষ করা যেতে পারে। ১. জমির আইলে ২. ক্ষেতের ভেতরে। জমির আইলে এক থেকে দেড় ফুট মাটি উঁচু করে ঢিবি বানাতে হবে। এটিই হবে সবজির মাদা। মাদাটি কচুরিপানা বা এ জাতীয় পচনশীল জিনিস দিয়ে বানালে ভালো হয়। কচুরিপানা পচে গেলে পলিমাটি বা বালু মিশ্রিত মাটি, গোবর সার/কেঁচো সার, ছাই মিশিয়ে ঢিবির মাথায় মাদা তৈরি করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে পানি ধরে রাখে এমন মাটি দিয়ে (এঁটেল মাটি) ঢিবি বা মাদা তৈরি করা যাবে না। তাতে মাদায় বেশি রস থেকে যাবে। এতে সবজি চারা মারা যেতে পারে।
ক্ষেতের ভেতরে সবজি চাষ করতে চাইলে জমি প্রস্তুত করার সময়ই মাটি বা কচুরিপানা দিয়ে উঁচু ঢিবি তৈরি করে নিতে হবে। অথবা সিমেন্ট বা মাটির রিং বসিয়ে মাদা তৈরির জন্য জায়গা বানানো যায়। এটি আপনি গ্রামের স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার রিং দিয়েও করতে পারেন। এই রিংয়ের ভেতরে কচুরিপানা, মাটি, গোবর ফেলে মাদা তৈরি করতে পারবেন। খেয়াল রাখুন, ক্ষেতের ভেতরে মাদা তৈরি করলে কিন্তু সেই ঢিবি বা মাদার উচ্চতা আইলে তৈরি মাদার চেয়ে বেশি হতে হবে। কারণ এই মাদাটি আপনাকে করতে হচ্ছে একেবারে পানির উপরে। তবে রিং বসিয়ে মাদা করলে ঢিবির উচ্চতা তুলনামূলক কম হলেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
চারা তৈরি
ধানের ক্ষেতে সবজি চাষের ক্ষেত্রে সরাসরি বীজ না বোনাই ভালো। এতে বীজ গজানোর হার খুব কম হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ এ পদ্ধতিতে মাদায় প্রচুর রস থাকে। এ কারণে আগে বীজ থেকে চারা তৈরি করে মাদায় রোপণ করতে হবে। নিচে লাউয়ের বীজ থেকে চারা তৈরির প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হলো:
বীজ বপনের সময় ও বীজের হার
আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। তবে বীজ উৎপাদনের জন্য অক্টোবরের শেষ দিকে বীজ বোনা উত্তম।
বীজ শোধন
বীজবাহিত রোগ প্রতিরোধ এবং সবল সতেজ চারা উৎপাদনের জন্য বীজ শোধন জরুরি। কেজিপ্রতি ২ ভিটাভেক্স/ক্যাপটান ব্যবহার করে বীজ শোধন করা যায়।
বীজতলা তৈরি
লাউ চাষের জন্য নার্সারিতে পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করে নিতে হবে। এজন্য আলো বাতাস স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায় এমন জায়গায় ২০-২৫ সেমি উঁচু বেড করে নিতে হবে। বেড়ের ওপর ৪-৫.২ মিটার আকৃতির ঘর তৈরি করে নিতে হবে। ঘরের কিনারা বরাবর মাটি হতে ঘরের উচ্চতা হবে ০.৬ মিটার এবং মাটি হতে ঘরের মধ্যভাগের উচ্চতা হবে ১.৭ মিটার। এ ঘর তৈরির জন্য বাঁশ, বাঁশের কঞ্চি, ছাউনির জন্য প্লাস্টিক এবং এগুলো বাঁধার জন্য সুতলি বা দড়ি দরকার হবে
বীজ বপন
বীজ বপনের জন্য ৮x ১০ সেমি. বা তার থেকে কিছুটা বড় আকারের পলিব্যাগ ব্যবহার করা যায়। প্রথমে অর্থেক মাটি ও অর্ধেক গোবর মিশিয়ে মাটি তৈরি করে নিতে হবে। মাটিতে বীজ গজানোর জন্য জো নিশ্চিত করে (মাটি জো না থাকলে পানি দিয়ে জো করে নিতে হবে) তা পলিব্যাগে ভরতে হবে। অতপর প্রতি ব্যাগে দুটি করে বীজ বুনতে হবে। বীজের আকারের দ্বিগুণ মাটির গভীরে বীজ পুঁতে দিতে হবে।
বীজতলায় চারা পরিচর্যা
নার্সারিতে চারার প্রয়োজনীয় পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে। বেশি শীতে বীজ গজানোর সমস্যা হয়। এজন্য শীতকালে চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বীজ গজানোর পূর্ব পর্যন্ত প্রতি রাতে প্লাস্টিক দিয়ে পলিব্যাগ ঢেকে রাখতে হবে এবং দিনে খোলা রাখতে হবে। চারায় প্রয়োজন অনুসারে পানি দিতে হবে তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে চারার গায়ে পানি না পড়ে। পলিব্যাগ এর মাটি চটা বাঁধলে তা ভেঙে দিতে হবে।
বীজের সহজ অংকুরোদগম
লাউয়ের বীজের খোসা কিছুটা শক্ত। তাই সহজ অংকুরোদগমের জন্য শুধু পরিষ্কার পানিতে ১৫-২০ ঘণ্টা অথবা শতকরা ১% পটাশিয়াম নাইট্রেট দ্রবণে এক রাত ভিজিয়ে অতপর পলিব্যাগে বুনতে হবে।
মাদায় চারা রোপণ
চারা রোপণের অন্তত সাতদিন আগে মাটি, বালু, ছাই ও গোবর বা কেঁচো সার দিয়ে মাদা প্রস্তুত করে রাখতে হবে। বিকালবেলা মাদায় চারা রোপণ করতে হবে। মাটিতে বেশি জো এসে থাকলে রোপণের পর সামান্য পানি দিন।
যত্ন
ধানের জন্য জমি প্রস্তুতের সময় বিভিন্ন রাসায়নিক সার তো দেওয়াই হয়। এই সার দেওয়া মাটির পাশাপাশি পচা কচুরিপানা ও কেঁচোসার যথেষ্ট পরিমানে দেওয়া হলে মাদায় নতুন করে আর সার দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। চারাগুলো এক দ্বিঘত পরিমান বড় হলে গোড়ায় ছোট কাঠি পুঁতে বেঁধে দিন যাতে হেলে না পড়ে। গাছ বড় হলে গেলে মাচ তৈরি করে দিতে হবে। বাঁশের খুঁটিতে প্লাস্টিকের দড়ির মাচা তৈরিতে খরচ বেশ কম হয়। লাউ, চিচিঙ্গা, করলা জাতীয় সবজিতে মাচা তৈরি করাটা জরুরি। তবে শিমের ক্ষেত্রে মাচা তৈরির দরকার নেই। একটি ঝাড়যুক্ত বাঁশের আগা বা গাছের ডাল পুঁতে দিলেই চলে।
বিশেষ পরিচর্যা
শোষক শাখা অপসারণ
গাছের গোড়ার দিকে ছোট ছোট ডালপালা হয়। সেগুলোকে শোষক শাখা বলা হয়। এগুলো গাছের ফলনে এবং যথাযথ শারীরিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায়। কাজেই গাছের গোড়ার দিকে ৪০-৪৫ সেমি. পর্যন্ত ডালপালাগুলো ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে অপসারণ করতে হবে।
ফল ধারণ বৃদ্ধিতে কৃত্রিম পরাগায়ন
লাউয়ের পরাগায়ন প্রধানত মৌমাছির মাধ্যমে হয়। প্রাকৃতিক পরাগায়নের মাধ্যমে বেশি ফল ধরার জন্য হেক্টর প্রতি দুটি মৌমাছির কলোনি স্থাপন করা প্রয়োজন। নানা কারণে লাউয়ের সব ফুলে প্রাকৃতিক পরাগায়ন ঘটে না এবং এতে ফলন কমে যায়। হাত দিয়ে কৃত্রিম পরাগায়ন করে লাউয়ের ফলন শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভর। লাউয়ের ফুল ঠিকমতো রোদ পেলে দুপুরের পর থেকে ফোটা শুরু হয়ে রাত ৭-৮টা পর্যন্ত ফোটে। কৃত্রিম পরাগায়ন ফুল ফোটার দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত এবং পরদিন সকাল পর্যন্ত করা যায়। তবে পরদিন সকালে পরাগায়ন করলে ফল কম ধরে কিন্তু ফুল ফোটার দিন সন্ধ্যাপর্যন্ত যে কয়টা ফুলে পরাগায়ন করা হয় তার সবটিতেই ফল ধরবে। কৃত্রিম পরাগায়নের নিয়ম হলো ফুল ফোটার পর পুরুষ ফুল ছিঁড়ে ফুলের পাপড়ি অপসারণ করা হয় এবং ফুলের পরাগধানী (যার মধ্যে পরাগরেণু থাকে) আস্তে করে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডে (যেটি গর্ভাশয়ের পেছনে পাপড়ির মাজখানে থাকে) ঘষে দেয়া হয়। একটি পুরুষ ফুল দিয়ে ২-৪টি স্ত্রী ফুলে পরাগায়ন করা যায়।
ফসল তোলা (পরিপক্বতা শনাক্তকরণ)
ফলের ভক্ষণযোগ্য পরিপক্বতা নিম্নোক্তভাবে শনাক্ত করা যায়।
১. ফলের গায়ে প্রচুর শুং এর উপস্থিতি থাকবে।
২. ফলের গায়ে নোখ দিয়ে চাপ দিলে খুব সহয়েই নোখ ডেবে যাবে।
৩. পরাগায়নের ১২-১৫ দিন পর ফল সংগ্রহের উপযোগী হয়।
লাউয়ের ফলের লম্বা বোঁটা রেখে ধারালো ছুরি দ্বারা ফল কাটতে হবে। ফল কাটার সময় যাতে গাছের কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। লাউ যত বেশি সংগ্রহ করা যাবে ফলন তত বেশি হবে।
ফলন : বারি লাউ-১ এবং বারি লাউ-২ যথাযথভাবে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৩৫-৪০ টন এবং বিঘাপ্রতি প্রায় ৪.৫-৫.০টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।
ধানের ক্ষেতে সবজি চাষের উপকারিতা
ক. একই জমিতে একসাথে দানা শস্য ও সবজি পাওয়া যায়
খ. প্রায় এক খরচে দুই ফসল চাষ
গ. শিম জাতীয় ফসল করলে জমির উর্বরতা বাড়ে
ঘ. একই জমিতে বারবার একই ফসল ফলানোর ফলে কমে যাওয়া উর্বরতা আবার ফিরে আসে
ঙ. এক ফসলী আবাদের ক্ষতি বা লোকসান থেকে মুক্তি
চ. জমিতে সবজির জন্য বাঁশের আগা, গাছের ডাল বা মাচা দেওয়ার কারণে পাখি বসতে পারে। এতে প্রাকৃতিক উপায়ে ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন হয়