Li-Fi বা Light Fidelity কি

 

খুবই সাধারণ ভাষায় বললে, Li-Fi হলো Light based Wi-Fi। ওয়াই ফাই টেকনোলজির সাহায্যে যেভাবে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে ডেটা ট্রান্সমিট করা হয়, ঠিক একইভাবে Li-Fi এর জন্য লাইট কে ব্যবহার করে ডেটা ট্রান্সমিট করা হয়। এখানে বিষয়টিকে শুনতে অনেকটা আজব লাগলেও এটিই প্রযুক্তি। এখানে মূল বিষয়টি হলো, আমরা বাড়িতে আলোর জন্য যে লাইট গুলো লাগাই, সেখানে Li-Fi লাইট গুলো কে ব্যবহার করেও ডেটা ট্রান্সমিশন করাও সম্ভব। আপনি যখন আপনার বাড়িতে কোন একটি বাল্ব এ আলো জ্বালানোর জন্য তাতে বিদ্যুৎ এর সংযোগ দেন, তখন সেটিতে তাৎক্ষণিক আলো জ্বলে।

এবার আমরা যদি সেই লাইটে বিদ্যুতের পরিবহন বন্ধ করে দেই; অর্থাৎ, সুইচ বন্ধ করে দেই তবে লাইট টিও বন্ধ হয়ে যায়। এখানেই বিষয়টি আমাদের কাছে অনেক সাধারণ একটি বিষয় মনে হচ্ছে। যেখানে আমরা লাইটের বিদ্যুৎ পরিবহন কে বন্ধ করে দিলে বাল্বটি এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই লাইট বন্ধ হবার পেছনে যে একটি বিষয় কাজ করছে, তা কি আমরা কখনও ভেবে দেখছি? এখানে অবশ্যই আমাদের উত্তর হবে, সেই বাল্বে ইলেকট্রনিক এর পরিবহন বন্ধ হবার কারণে বাল্ব টি বন্ধ হয়েছে।

ঠিক একই ভাবে আমরা যদি ইন্টারনেটের সকল ডেটা ট্রান্সমিশন এর কথা চিন্তা করি, তবে ব্যাপারটি কি? এখানে অবশ্যই আমাদেরকে ভাবতে হবে একই স্থান থেকে অন্য স্থানে আমাদের তথ্য আদান-প্রদান করার জন্য তরঙ্গ ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রথমে আমাদের ডিভাইস থেকে আমাদের তথ্যগুলো ডিজিটাল ফরম্যাটে কনভার্ট হয়ে সেগুলো 0 এবং 1 এ পরিণত হচ্ছে। এবং এই 0 এবং 1 পরবর্তীতে তরঙ্গ আকারে আমাদের রাউটারে যাচ্ছে অথবা আমাদের ডিভাইস থেকে মোবাইল নেটওয়ার্ক কে চলে যাচ্ছে এবং সেখান থেকে আমাদের সেই তথ্যটি আলোর গতিতে অপটিক্যাল ফাইবারের ভেতর দিয়ে তার গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। ইন্টারনেটে এভাবে করেই আমাদের ডাটাগুলোকে ট্রান্সলেশন করা হচ্ছে।

Li-Fi বা Light Fidelity এর কাজ করা প্রক্রিয়া

আমরা যে সমস্ত ডেটা গুলো ডিজিটাল দুনিয়ায় দেখতে পাই সেগুলোর সমস্তই 0 এবং 1 হিসেবে সকল জায়গায় জমা থাকে। আর 0 এবং 1 হিসেবে আমাদের ডিভাইসে ও সকল তথ্য গুলো ইন্টারনেট থেকে চলে আসে। আমরা এটি সকলেই জানি যে, ডিজিটাল দুনিয়ায় সকল কিছু 0 এবং 1 এর উপর নির্ভর করে হয়। এবার আমরা যদি ধরে নেই, কোন একটি বাল্ব দিয়ে যদি কারেন্ট প্রবাহিত না হয়, তবে তা ০ হবে এবং যখন সেই বাল্ব এর ভেতর দিয়ে কারেন্ট প্রবাহিত হবে তখন সেটি ১ হবে। আর এভাবে করে যদি কোনো একটি বাল্ব কে খুবই দ্রুত চালু এবং বন্ধ করা হয়, তবে সেখানে ০ এবং ১ এর ডেটা সেট তৈরি হয়।

আর এই ডেটাসেট কে রিসিভার থেকে রিসিভ করে ওয়াইফাই এর মত করে ইন্টারনেট চালানো সম্ভব। এবার আপনার মনে হতে পারে আপনার ঘরের বাল্ব কে যদি বারবার এভাবে করে চালু এবং বন্ধ করা হয়, তবে এক্ষেত্রে আপনার ঘরের মধ্যে তো থাকা অসম্ভব হতে পারে। এক্ষেত্রে আপনাকে বলে রাখি যে, আপনার ক্ষেত্রে যদি বৈদ্যুতিক বাল্ব লাগানো থাকে, অর্থাৎ আপনার ঘরের ভেতরে যদি কোনো AC বাল্ব লাগানো থাকে, তবে সেটি চালু থাকা অবস্থায় সেকেন্ডে ৫০-৬০ বার চালু এবং বন্ধ হচ্ছে। কারণ আমরা যে বিদ্যুৎ বাড়িতে ব্যবহার করি তার ফ্রিকুয়েন্সি ৫০ হার্জ। এই বিষয়টি আপনি যদি কোন বৈদ্যুতিক যন্ত্র কিনতে যান, তবে সেই বৈদ্যুতিক যন্ত্রের গায়ে লেখা দেখে পারেন।

আপনি আপনার ঘরের ভেতরে থাকা বাল্ব কে খালি চোখে এভাবে করে বন্ধ এবং চালু হতে দেখতে পাবেন না। তবে আপনি যদি মোবাইল ফোনের ক্যামেরা চালু করে বাল্বের দিকে ধরেন, তবে এই বিষয়টিকে আপনি উপভোগ করতে পারবেন। তবে Li-Fi বা Light Fidelity এর ক্ষেত্রে বাল্বের যে Flickering বা ঝাঁকুনি টি হবে, এটি আপনি বুঝতেও পারবেন না। কারণ সেখানে অনেক বেশি ফ্রিকুয়েন্সি কে ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা এখানে অনেক পরিমাণে ডেটা সেন্ড এবং রিসিভ করার প্রয়োজন রয়েছে।


এক্ষেত্রে ইন্টারনেট নেওয়ার ক্ষেত্রে যে কানেকশনটি আপনার বাড়িতে আসবে, সেটি প্রথমে একটি মডেম এর মধ্যে যাবে। এরপর মডেম থেকে যেটি একটি এলইডি ড্রাইভার এর মধ্যে যাবে, যদি আপনার বাড়িতে সেই এলইডি লাইট কে নিয়ন্ত্রণ করবে। এবার সেখান থেকে সেই সিগন্যাল টিকে রিসিভারে ইলেকট্রনিক্স সিগনালে পরিণত করা হবে এবং যেটি আপনার কম্পিউটার এর ভেতরে দেওয়া হবে। যার ফলে আপনার কম্পিউটার ইন্টারনেট কানেকশন পাবে। আর এটিই হচ্ছে Li-Fi বা Light Fidelity এর সাধারন ডায়াগ্রাম।

ওয়াইফাই থাকা সত্ত্বেও আমাদের কেন Li-Fi এর দরকার পরলো?

আমরা বর্তমানে ওয়াইফাই এর মাধ্যমে অনেক দ্রুত গতির ইন্টারনেট ব্রাউজ করছি। যেখানে মোবাইল ডাটা ব্যবহার করার চাইতে ওয়াইফাই এর গতি অনেক পরিমাণে বেশি এবং এটি দিয়ে যেকোনো জায়গা থেকে একই স্পিড পাওয়া যায়। শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সবাই একই গতিতে ইন্টারনেট চালাতে পারে। কিন্তু এই দ্রুতগতির ইন্টারনেট পাওয়া সত্বেও কেন আমরা এই নতুন প্রযুক্তির Li-Fi কে ব্যবহার করব সেটিই এখন প্রশ্ন। চলুন তবে ওয়াইফাই বাদ দিয়ে Li-Fi বা Light Fidelity এর কিছু কারণ জেনে নেওয়া যাক।

Li-Fi বা Light Fidelity ব্যবহার করার তিনটি কারণ রয়েছে। একটি হলো, দিন দিন আমাদের ডেটার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এছাড়া যে সমস্ত ডিভাইসগুলো আমরা ব্যবহার করি, সেগুলোর সমস্ত কিছুকে তারের সঙ্গে সংযুক্ত করা সম্ভব নয়। আর এজন্য আমাদের ব্যবহৃত সমস্ত ডিভাইসগুলোকে ওয়ারলেস হওয়া দরকার। আর তৃতীয়ত, “Internet of things”।

মানে, আগে আমরা শুধুমাত্র মোবাইল এবং কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহার করতাম। কিন্তু বর্তমানে আমাদের ব্যবহৃত হাত ঘড়ি থেকে শুরু করে বাড়িতে ব্যবহৃত টিভি, ফ্রিজ সবকিছুতেই ইন্টারনেট ব্যবহার হয়। আর ভবিষ্যতে এমন হতে চলেছে, যখন বাড়ির দরজার তালা চাবি ও ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। আর এসবের জন্য আমাদের অবশ্যই উচ্চগতির ইন্টারনেট এর খুবই প্রয়োজন। আমাদের ওয়াইফাই এর সাথে যে সমস্যাটি উঠে আসে তা হচ্ছে, ওয়াইফাই এর স্পিড অনেক কম।

এবার ধরুন, আপনার বাড়িতে থাকা ওয়াইফাই এর সঙ্গে যদি একটি কিংবা দুইটি ডিভাইস সংযুক্ত থাকে, তবে আপনি বুঝতে পারবেন না আপনার ওয়াইফাই এর গতি কম নাকি বেশি। যেখানে এই স্পিড টিকে আপনার কাছে সাধারন ই মনে হবে। এবার আপনি যদি কোনো একটি পাবলিক প্লেসে যান, যেখানে ওয়াই-ফাই এর অ্যাক্সেস সবাইকে দেওয়া হয়েছে। তখন আপনি সেখানে বুঝতে পারবেন সেই ওয়াইফাই আপনাকে এতগুলো মানুষের মাঝে ভালোভাবে সার্ভিস দিতে সমর্থ না। যেখানে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে গেলে স্পীড অনেক কমে যায় এবং ওয়াইফাই এর সিকিউরিটি সিস্টেম ততটা ও ভালো নয়।

ওয়াইফাই এর সঙ্গে Li-Fi বা Light Fidelity এর গতির পার্থক্য

তো, এই Li-Fi এর কথা আমরা যখন প্রথম শুনি, তখন বলা হয়, Li-Fi বা Light Fidelity এর মাধ্যমে দ্রুতগতিতে এবং অনেক বেশি ডেটা একসঙ্গে আদান-প্রদান করা যাবে। এটি বলা হয় যে, এটি অনেক অনেক পরিমাণে ফাস্ট হবে এবং ১০০% সিকিউর হবে। যেহেতু Li-Fi কে ব্যবহার করতে হলে আপনাকে সেই লাইটের কাছেই থাকতে হবে এবং এর জন্য ওয়াইফাই এর চাইতে এর সিকিউরিটি ও অনেক বেশি থাকবে। তবে বাস্তব এর থেকে অনেক বেশি আলাদা। ২০১৭ সালে যখন প্রথমে কিছু লাইফাই ডিভাইস আসে, তখন দেখা যায় সেসবের স্পিড অনেক কম; মাত্র ৪৩ এমবিপিএস।

তবে সেই বছরই যদি ওয়াইফাই এর দিকে নজর দেওয়া যায় তবে তখন ১০০ এমবিপিএস এবং ৩০০ এমবিপিএস পাওয়া যেত। তবে বর্তমানে 1Gbps এর লাই-ফাই ও পাওয়া যায়। তবে সেগুলোর দাম অনেক বেশি। এতো এতো সুবিধার পরেও লাই-ফাই ব্যবহার করা সুবিধাজনক নয়। কেননা এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই লাইট কে জ্বালিয়ে রাখতে হবে।

এবার আপনি যদি মনে করেন দিনের বেলায় লাইট বন্ধ করে রাখবেন, তবে ইন্টারনেট কিন্তু আর কাজ করবে না। কেননা লাই-ফাই এর মাধ্যমে ইন্টারনেট চলে একমাত্র আলোর কারণে। যেখানে আলো বন্ধ এবং চালুর মাধ্যমে কোন ডেটার ডিজিটাল ফরমেট প্রকাশ পায়। এক্ষেত্রে আলো বন্ধ হলে ০ এবং চালু হলে ১। এভাবে বাল্বের দ্রুত গতিতে অন এবং অফ এর মাধ্যমে ইন্টারনেট চলে।

ইন্টারনেট চালানোর জন্য সবসময় লাইট জ্বালিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তার কারণে এটি ব্যবহার করতে অনেক ঝামেলা রয়েছে। যে কারণে এই টেকনোলজিতে অতটা সফলতার মুখ দেখেনি। পূর্বে যেসব ওয়াইফাই রাউটার গুলো পাওয়া যেত সেগুলো সিম্প্লেক্স ছিল। অর্থাৎ, সেটিতে হয় আপনাকে ডেটা সেন্ড করতে হবে, নয়তো রিসিভ করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে ডুপ্লেক্স রাউটার পাওয়া যায় এবং যেগুলোর মাধ্যমে ডেটা সেন্ড এবং রিসিভ করা যায়।
তাই ওয়াই-ফাই এর ক্ষেত্রে আগের চাইতে স্পিডের সমস্যাটি অনেক কম হয়েছে। যে কারণে এই Li-Fi বা Light Fidelity প্রযুক্তিকে যতটা সফল প্রযুক্তি হিসেবে মনে করা হয়েছিল, কিন্তু এই টেকনোলজি তা করতে পারেনি। তবে লাইফাই সম্পর্কে আপনার কি মতামত? ওয়াইফাই প্রযুক্তি কি আমাদের জন্য ভালো হবে নাকি ওয়াইফাই আমাদের জন্য ভাল? আপনার কাছে খুবই ভালো লাগে তা অবশ্যই নিচের কমেন্ট বক্সে জানাবেন।

এখানে আমার মতামত হিসেবে অবশ্যই আমাকে ওয়াইফাই প্রযুক্তি ভালো লাগে। যেখানে এত সব ঝামেলার কোন কারণ নেই এবং সারাক্ষণ লাইট জ্বালিয়ে আমাকে ইন্টারনেট চালাতে হবে না। আশা করছি আপনিও লাইফাই প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। যদি আপনার কাছে ভালো লাগে তবে আপনাদের বন্ধুদের মাঝে ও শেয়ার করে দিতে ভুলবেন না।

Previous Post Next Post