অবৈধ দখলদার, প্রভাবশালী নেতা বা ব্যক্তির দ্বারা সারা দেখে সম্পত্তি বেদখল হওয়া এখন সাধারণ একটা ব্যাপার। আর ভুক্তভোগী তখন নিরুপায় হয়ে হয় চুপ হয়ে যান নতুবা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যান। কিন্তু এই ধরনের কোন হুমকি বা সমস্যার সম্মুখীন হলে আপনিও আইনগতভাবে তা প্রতিহত করতে পারেন। সাধারণত, সম্পত্তি বেদখল বলতে বোঝায় প্রকৃত মালিক বা দখলদারকে তার মালিকানা বা দখল থেকে জোর করে উচ্ছেদ করে অবৈধভাবে সেখানে অন্য ব্যক্তির স্বত্ব বা দখল প্রতিষ্ঠিত করা। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রায়ই প্রকৃত মালিকাকে জোরপূর্বক তার জমি থেকে উচ্ছেদ করে কিংবা চাতুরির আশ্রয় নিয়ে অন্যকে জমি থেকে চলে যেতে বাধ্য করে।
অনেকে দখলচ্যুত হলে থানায় মামলা করতে চাই। পুলিশকে দিয়ে দখল পুনরুদ্বার করতে চায়। অপরাধ যেমন আছে তা প্রতিকারেও আইনও আছে, শুধু জানা দরকার সঠিক আইনের সাহায্য নেয়ার প্রক্রিয়া। আইন আপনাকে আপনার বৈধ জমি ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা দিচ্ছে। কিন্তু অনেকেই জানেন না বেদখল হলে তার করণীয় কী? ব্যক্তি কর্তৃক স্থাবর সম্পত্তি হতে বেদখল হলে দখল পুনরুদ্বারের জন্য আপনার করণীয় বিষয়গুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
জমি বেদখল হলে প্রতিকার জমি থেকে বেদখল হলে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য দুই রকমের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। প্রথমত স্থানীয়ভাবে সালিশের মাধ্যমে বিরোধের নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা যেতে পারে। যেসব অঞ্চলে সালিশি প্রথা বিজ্ঞজনদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় এবং যেখানকার অধিবাসীরা শান্তিপ্রিয় ও যুক্তিবোধসম্পন্ন, তারা এই উপায়ে এরকম বিরোধের নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করে থাকে। এতে মামলা-মোকদ্দমার মতো দীর্ঘ প্রক্রিয়া এড়ানো যায়। স্থানীয় বিজ্ঞজনরা সালিশে বসে ন্যায়ানুগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যদিয়ে জমির আসল মালিককে তার জমির দখল বুঝিয়ে দিতে পারেন।
জমি থেকে বেদখল হলে প্রতিকার পাওয়ার আরেকটি উপায় আদালতে মামলা-মোকদ্দমা চালানো। ফৌজদারি ও দেওয়ানি এই দুই প্রকার আইনেই জমি বেদখল হওয়ার বেশকিছু প্রতিকার পাওয়া যায়।
গ্রাম্য আদালতে মামলা কিংবা স্থানীয় সালিশ বিচার আশ্রয়: আপনি এ ব্যাপারে প্রথমে গ্রাম্য আদালতে অভিযোগ করবেন কিংবা এলাকার মাতব্বর/মুরুব্বিদের জানিয়ে তাদের আপনার জমির বৈধ কাগজ দেখিয়ে দখল ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান করতে পারেন। এক্ষেত্রে গ্রাম্য আদালত কিংবা মাতব্বর/মুরুব্বিরা আপনাকে এবং অবৈধ দখলদারকে ডেকে বৈঠকের মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারেন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই যে অবৈধ দখল নেয়, তার প্রভাবের কাছে স্থানীয় বিচার টিকে না, এক্ষেত্রে যদি বৈঠকের সিদ্ধান্ত আপনার পক্ষে না যায় তবে হতাশ হবেন না। আপনার ওপর কেউ কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারবে না। বৈঠকের সিদ্ধান্ত আপনি যদি না মানেন তবে তাদের পরিষ্কার করে বলে দেবেন যে আমি আপনাদের সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারছি না ফলে আমি আদালতে আইনের শরণাপন্ন হবো। আইন ও আদালত আপনার জমি ফিরে পেতে আপনাকে যথেষ্ট প্রতিকার দিচ্ছে। এক্ষেত্রে আপনি ফৌজদারি আদালত অথবা দেওয়ানি আদালত দুই আদালতেই আপনার জমি ফিরে পেতে মামলা করতে পারবেন।
আদালতে মামলা আদালতে যত মামলা-মোকদ্দমা হয়, তার একটা বড় অংশই জমিজমাকে কেন্দ্র করে। জমি বেদখল হলে আইনে আপনার জন্য দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় রকমের প্রতিকারই রয়েছে। এর কোনোটি তাৎক্ষণিক আবার কোনোটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দেবে। সব প্রতিকারের বিষয়ে জানা থাকলে অধিকার প্রতিষ্ঠায় আপনি এগিয়ে থাকবেন।
ফৌজদারি আদালতে মামলা: ফৌজদারি আদালতে মামলা করলে আপনি দ্রুত প্রতিকার পাবেন, ফলে প্রথমে এখানেই যাওয়া উচিত। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারা মতে যদি কোনো ব্যক্তি তার দখলকৃত জমি হতে (মালিকানা থাক বা না থাক) হঠাৎ করে বেদখল হয়ে যায় কিংবা কোনো ব্যক্তি তাকে জোরপূর্বকভাবে বেদখল করে তাহলে জমি হতে বেদখল হওয়ার পর তাকে ফৌজদারি আদালতে মামলা করতে হবে। ফৌজদারি আদালতে মামলা করার ক্ষেত্রে কিছুটা সময় বেঁধে দেয়া আছে আইনে, কোনো ব্যক্তি তার সম্পত্তি হতে বেদখল হওয়ার দুই মাসের মধ্যে তিনি উক্ত ব্যক্তিকে বেদখল করার চেষ্টা হতে বিরত করার জন্য বা সম্পত্তিতে ওই ব্যক্তির প্রবেশ রোধ করার আদেশ প্রদানের জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারার বিধান অনুসারে মামলা করতে পারবেন। অন্যথায় আপনি এই আদালতে মামলা করার এখতিয়ার হারাবেন। ফৌজদারি আদালতে মামলা করার ক্ষেত্রে এলাকার নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য নিয়োজিত অতিরিক্ত জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রে কিংবা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করতে হবে। এ ধরনের মামলা অল্প সময়ের মধ্যেই নিষ্পত্তি হয় থাকে। তবে মামলা করার পূর্বে থানায় ঘটনার বিষয়ে একটি জিডি করতে পারেন।
কীভাবে ফৌজদারি আদালতে মামলা? কোনো ব্যক্তি তার সম্পত্তি থেকে বেদখল হওয়ার দুই মাসের মধ্যে একজন আইনজীবীর মাধ্যমে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ অথবা ১৪৫ ধারার বিধান অনুসারে মামলা করতে পারবেন। বিবাদীকে দখল করা থেকে নিবৃত্ত করার জন্য বা জমিতে ওই ব্যক্তির প্রবেশ নিষিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে এই ধারাগুলোর অধীনে আদেশ প্রদান করতে পারেন প্রথম শ্রেণির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এ ধরনের মামলা খুব কম সময়ের মধ্যেই নিষ্পত্তি হয়ে থাকে।
১৪৪ ধারায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে উৎপাত বা আশঙ্কিত বিপদের ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ আদেশ জারির ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এই ধারা অনুসারে, যেসব ক্ষেত্রে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমতাপ্রাপ্ত অন্য কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মনে হয় যে, এই ধারার অধীনে অগ্রসর হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে এবং সমস্যার আশু নিবারণ বা দ্রুত প্রতিকার বাঞ্ছনীয়, সেসব ক্ষেত্রে যেকোনো ব্যক্তিকে ওই ম্যাজিস্ট্রেট কোনো নির্দিষ্ট কাজ করা থেকে বিরত থাকার অথবা কোনো নির্দিষ্ট সম্পত্তি তার দখলে কিংবা তার অধীনে নেয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন, যদি ওই ম্যাজিস্ট্রেট বিবেচনা করেন, তার নির্দেশের কারণে আইনসঙ্গতভাবে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তির প্রতি বাধা, বিরক্তি বা ক্ষতি অথবা বাধা, বিরক্তি বা ক্ষতির ঝুঁকি, অথবা মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য বা নিরাপত্তার প্রতি বিপদ অথবা জনশান্তির বিরক্তি, দাঙ্গা বা মারামারি নিরোধের সম্ভাবনা আছে কিংবা তার এই নির্দেশ তা নিরোধে সহায়তা করবে।
দখলদারকে পুনর্বহাল যখন কোনো জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ রিপোর্ট বা অন্য কোনোভাবে সংবাদ পেয়ে এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, তার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে জমি, পানি বা এ দুটির সীমানা সম্পর্কে এমন একটি বিরোধ রয়েছে, যা শান্তিভঙ্গের কারণ হতে পারে, তখন তিনি তার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিরোধের পক্ষদের সশরীরে বা আইনজীবীর মাধ্যমে তার আদালতে হাজির হওয়ার এবং বিরোধের বিষয়বস্তুতে প্রকৃত দখল সম্পর্কে তাদের নিজ নিজ দাবি সম্পর্কে বিবৃতি পেশ করার নির্দেশ দিয়ে একটি লিখিত আদেশ দেবেন। উভয় পক্ষ নির্ধারিত তারিখে নিজ নিজ বিবৃতি পেশ করলে ম্যাজিস্ট্রেট সেগুলো পড়বেন, প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন এবং কোন পক্ষ জমির দখলে ছিল সেটি নির্ণয় করার চেষ্টা করবেন। পূর্ববর্তী দুই মাসের মধ্যে যদি কোনো পক্ষ জোরপূর্বক বেদখল হয়ে থাকেন, তাকে ওই সম্পত্তির দখলদার হিসেবে বিবেচনা করবেন ম্যাজিস্ট্রেট। একই সঙ্গে তাকে তার জমিতে পুনর্বহাল করার উদ্যোগ নেবেন। দেওয়ানি আইনের ডিক্রির মাধ্যমে আইনসঙ্গতভাবে উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত দখলে থাকা পক্ষ দখল বহাল রাখবে মর্মে ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ দেবেন। আইনগতভাবে উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত ওই দখলের প্রতি সব ব্যাঘাত ঘটানো নিষিদ্ধ করে ম্যাজিস্ট্রেট একটি আদেশ দেবেন।
দেওয়ানি আদালতে মামলা এক্ষেত্রে একটা জিনিস লক্ষণীয় আপনি যদি আপনার জমি বেদখল হওয়ার দুই মাসের মাঝে ফৌজদারি আদালতে মামলা করতে ব্যর্থ হন তবে সেক্ষেত্রে আপনার জন্য দেওয়ানি আদালতে মামলা করার পথ খোলা থাকবে। দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে হলে জমি বেদখল হয়ার তারিখ হতে ছয় মাসের মধ্যে মামলা করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে মামলার রায় পেতে কিছুটা সময় লাগবে। দেওয়ানি আদালতে বেদখল হওয়া জমির জন্য মামলা করতে হলে আপনাকে আপনার জমির মূল্য হিসেবে দেওয়ানি আদালতের বিভিন্ন জজ আদালতে যেতে হবে। যেমন- (১) বেদখল সম্পত্তির মূল্য যদি দুই লাখ টাকা পর্যন্ত হয় তাহলে জমিটি যে এলাকায় অবস্থিত সেই এলাকার সহকারী জজের নিকট মামলা দায়ের করতে হবে। (২) বেদখল সম্পত্তির মূল্য যদি দুই লাখ এক টাকা থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত হয় তাহলে জমিটি যে এলাকায় অবস্থিত সেই এলাকার সিনিয়র সহকারী জজের নিকট মামলা দায়ের করতে হবে। (৩) বেদখল সম্পত্তির মূল্য যদি চার লাখ এক টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত হয় তাহলে জমিটি যে এলাকায় অবস্থিত সেই এলাকার যুগ্ম জেলা জজের নিকট মামলা দায়ের করতে হবে। (৪) বেদখল সম্পত্তির মূল্য যদি পাঁচ লাখ এক টাকা থেকে অসীম পর্যন্ত হয় তাহলে জমিটি যে এলাকায় অবস্থিত সেই এলাকার জেলা জজ অথবা অতিরিক্ত জেলা জজের নিকট মামলা দায়ের করতে হবে। যদি আপনার জমি বেদখল হয়ে যাওয়ার দুই মাস বা ছয় মাসের মাঝেও মামলা করতে পারলেন না কোনো কারণে তখন কী করবেন? এক্ষত্রে আপনি আপনার জমির দখল হারানোর ছয় মাসের বেশি হলে এবং ১২ বছরের ভেতরে হলে মামলা করতে পারবেন ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮/৯ এবং ৪২ ধারা মোতাবেক এখতিয়ার ভুক্ত দেওয়ানী আদালতে। সুতরাং, বিষয়সমূহ জানা থাকলে নিজের এবং অন্য কারর বিপদে এগিয়ে যেতে পারবেন। বাদী যদি সম্পত্তিতে নিজের স্বত্ব (মালিকানা) প্রমাণে সমর্থ নাও হন কেবল বেদখল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দখলে ছিল প্রমাণ করতে পারেন তবেই তিনি তার পক্ষে ডিক্রি পেতে পারেন। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা মতে প্রদত্ত ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বা রিভিউ করার কোন বিধান নেই। তবে মহামান্য হাইকোর্টে রিভিশন করা যাবে। কিন্তু সরকার কর্তৃক বেদখল হলে এ আইনে কোন প্রতিকার পাওয়া যাবে না। আবার ৬ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলে মামলা তামাদি দোষে বারিত হবে। তবে তামাদি আইনে দখলচ্যুতির ১২ বছরের মধ্যে মোকদ্দমা করা যায়।
কীভাবে দেওয়ানি আদালতে মামলা? জমি থেকে বেদখল হলে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের বেশ কয়েকটি ধারায় মামলা করা যায়।
৯ ধারার মামলা: ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারার অধীনে দেওয়ানি আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করে জমির দখল পুনরুদ্ধার করা যায়। যিনি ভূমি থেকে বেদখল হয়েছেন তাকে বেদখল হওয়ার তারিখ থেকে ছয় মাসের মধ্যে দখল পুনরুদ্বারের দাবিতে মামলা করতে হবে। ছয় মাস অতিবাহিত হয়ে গেলে মামলা তামাদি দোষে বারিত হবে। এভাবে ৯ ধারায় মামলা করে আদালতের মাধ্যমে দখল পুনরুদ্ধার করা যায়। তবে ৯ ধারার মামলা দায়ের করলে 'জমির মূল স্বত্ব কার' সেই প্রশ্নের নিষ্পত্তি হবে না। এর জন্য একই আইনের ৪২ ধারায় প্রতিকার আছে। একটি জমিতে কোনো ব্যক্তির জমির স্বত্ব যদি অস্বীকার করে যদি তাকে উচ্ছেদ করা হয় তবে জমির দখলে থাকা ব্যক্তি এই ধারায় প্রতিকার চাইতে পারেন। ৯ ধারায় মামলার প্রতিকার শুধু দখলসংক্রান্ত। আদালতের মাধ্যমে দখল পুনরুদ্ধার করা যাবে বটে কিন্তু ভূমির মালিকানার প্রশ্নটি এই ধারার অধীনে বিচার্য হবে না। এমনকি বাদী যদি সম্পত্তিতে নিজের স্বত্ব (মালিকানা) প্রমাণে সমর্থ নাও হন কেবল বেদখল হওয়ার আগ পর্যন্ত দখলে থাকা প্রমাণ করতে পারেন তবেই তিনি তার পক্ষে ৯ ধারার অধীনে ডিক্রি পেতে পারেন এবং বিবদমান ভূমিতে পুনর্বহাল হতে পারেন। সরকার কর্তৃক বেদখল হলে এ ধারায় কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না।
৮ ধারায় মামলা: সম্পত্তিতে যার বৈধ মালিকানা স্বত্ব আছে তিনি কোনো কারণে বেদখল হলে পরবর্তী ১২ বছরের মধ্যে ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ধারা মতে দেওয়ানি আদালতে মামলা করে সম্পত্তির দখল পুনরুদ্ধার করতে পারেন। এ ধারায় মামলা করতে হলে সম্পত্তিতে বাদীর মালিকানা স্বত্ব থাকতে হবে।
৪২ ধারায় মামলা: সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের এই ধারায় কোনো মর্যাদা বা অধিকার সম্পর্কে আদালতের ঘোষণা পাওয়া যেতে পারে। আইনানুগ পরিচয় কিংবা কোনো সম্পত্তির স্বত্বের অধিকারী কোনো ব্যক্তি এমন যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে পারে, যে ব্যক্তি পূর্বোক্ত ব্যক্তির মর্যাদা বা অধিকারের ব্যাপারে তার স্বত্ব অস্বীকার করেছে কিংবা অস্বীকার করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। উদাহরণ- আপনার জমিতে হঠাৎ করেই আপনার প্রতিবেশী অংশ দাবি করছে। এমন অবস্থায় আপনি ৪২ ধারায় আদালতের কাছ থেকে এই মর্মে ঘোষণা নিয়ে আসতে পারেন যে, আপনার দলিলে বর্ণিত জমিতে অন্য কারো অধিকার নেই। যেখানে কেবল স্বত্বের ঘোষণা ছাড়াও আরো প্রতিকার দাবি করা যেত, কিন্তু বাদী তা করা থেকে বিরত থাকে, সেখানে আদালত শুধু ঘোষণা প্রদান করবে না। যেমন যেখানে আপনাকে জমি থেকে বেদখল করা হয়েছে, সেখানে শুধু ৪২ ধারায় ঘোষণার মামলা করলে চলবে না, তার আগে জমির দখল পুনরুদ্ধারে ৮ কিংবা ৯ ধারায় মামলা করা হয়েছে কি না, আদালত সেটি দেখবে।
জমি নিয়ে বিরোধ হলে প্রতিকার জমিজমাকে কেন্দ্র করে যেকোনো সময় বিরোধ দেখা দিতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, নিজের কেনা জমি অন্য কেউ দখল করে মালিকানা দাবি করছে কিংবা জাল দলিল তৈরি করে জমির দখল নিতে চায়। আদালতে মিথ্যা মামলাও ঠুকে দেয়। কিন্তু একটু সচেতন হলেই এ ঝামেলা থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া সম্ভব। সে জন্য জানা থাকতে হবে জমি নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে কীভাবে প্রতিকার পাবেন।
ফৌজদারি প্রতিকার জমি দখলকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চাইতে পারেন। এ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চাইতে হবে প্রথম শ্রেণির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। আর এ মামলা করতে হবে বেদখল হয়ে গেলে কিংবা বেদখল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেওয়ার দুই মাসের মধ্যে। কোনো মামলা করলে ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিপক্ষের ওপর সমন জারি করবেন। পরবর্তী সময়ে উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনবেন এবং সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে সম্পত্তির দখলদার কে তা নির্ধারণ করবেন। প্রয়োজনে সরেজমিনে তদন্তের আদেশ দিতে পারেন পুলিশকে। তাদের দেওয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রকৃত দখলদার কে, সে বিষয়ে রায় দেবেন। তবে ১৪৫ ধারায় প্রতিকার চাইতে গেলে এখানে স্বত্ব বা মালিকানা দাবি করা যাবে না। এর মাধ্যমে শুধু প্রকৃত দখলদার নির্ণয় করার জন্য প্রতিকার চাওয়া যাবে।
মালিকানা দাবি করবেন যেভাবে জমির মালিকানা বা স্বত্ব দাবির জন্য দেওয়ানি আদালতের আশ্রয় নিতে হবে। জমি অবৈধভাবে দখলচ্যূত হলে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ও ৯ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার পেতে পারেন। এ আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী জমির মালিক নির্ধারিত পদ্ধতিতে জমিটি পুনরুদ্ধার করার জন্য প্রতিকার চাইতে পারেন। তবে এ ধারা অনুযায়ী, দখলচ্যূত ব্যক্তিকে জমিতে তাঁর স্বত্ব বা মালিকানা আছে কিংবা মালিকানার দাবি রয়েছে, তার ঘোষণা চাইতে হবে। না হলে এ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হয় না। ৮ ধারার স্বত্ব প্রমাণসহ মামলা করার ক্ষেত্রে বেদখল হওয়ার পর থেকে ১২ বছরের মধ্যে মামলা করার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের মামলাকে সাধারণত স্বত্ব সাব্যস্ত খাস দখলের মামলা বলা হয়। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা অনুযাযী প্রতিকার চাইতে হলে মালিকানা প্রমাণের দরকার নেই। শুধু জমি থেকে দখলচ্যুত হয়েছেন এটি প্রমাণ করলেই চলবে। ৯ ধারায উল্লেখ আছে, যদি কোনো ব্যক্তি বেদখল হন, তবে তিনি বা তাঁর মাধ্যমে দাবিদার কোনো ব্যক্তি মোকদ্দমার মাধ্যমে এর দখল পুনরুদ্ধার করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে যেসব দিক বিবেচনা করা হয়, সেগুলো হলো বাদী অর্থাৎ যিনি প্রতিকার দাবি করেছেন, তিনি জমিটি দখল করে আসছিলেন কি না; বিবাদী তাঁকে জোরপূর্বক বেদখল করেছেন কি না; বিবাদী বেআইনিভাবে জমিতে প্রবেশ করেছেন কি না। তবে বাদীকে অবশ্যই বেদখল হওয়য়ার ছয় মাসের মধ্যে মামলা করতে হবে। অন্যথায় এ ধারায় মামলা করার অধিকার হারাতে হবে তাঁকে। তবে সরকারের বিরুদ্ধে এ ধারায় প্রতিকার চাওয়া যাবে না।
কোথায় ও কীভাবে আইনের আশয় নেবেন জমিজমার মালিকানা নিয়ে প্রতিকারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এখতিয়ারাধীন আদালতে মামলা করতে হবে। মামলা দায়ের করতে হবে আইনজীবীর মাধ্যমে। মালিকানাসহ দখলের প্রতিকার চাইলে জমির মূল্য বাবদ অ্যাড-ভ্যালোরেম (মূল্যানুপাতে) কোর্ট ফি দিতে হবে। ৯ ধারা অনুযায়ী শুধু দখলের জন্য প্রতিকার চাইলে সম্পত্তির মূল্য অনুসারে যে কোর্ট ফি তার অর্ধেক, অর্থাৎ অ্যাড-ভ্যালোরেম কোর্ট ফির অর্ধেক পরিমাণ কোর্ট ফি দিতে হবে। জমির মালিকানাসহ দখল কিংবা শুধু দখল চেয়ে প্রতিকারের ক্ষেত্রে যদি বাদী মনে করেন, তাঁর জমিটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাহলে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাইতে পারেন পৃথক আবেদনের মাধ্যমে।
আইন আপনাকে আপনার দখল হারান জমি ফিরে পাওয়ার জন্য সকল সুবিধাই দিচ্ছে। আপনার শুধুমাত্র সঠিক আইনের ধারা এবং প্রক্রিয়া জানা থাকা প্রয়োজন। জমির দখল আজকে হারান-নি তো কি, ভবিষ্যতে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়তেও পারেন।
লেখক: পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত), বাঞ্ছারামপুর মডেল থানা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।