সূর্যমুখীর চাষ পদ্ধতি এর বিস্তারিত !!!

 


জমি তৈরি

সূর্যমুখীর জমি গভীরভাবে চাষ হওয়া প্রয়োজন। জমি ৪-৫ বার আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।

বপনের সময়
সূর্যমুখী সারা বছর চাষ করা যায়। তবে অগ্রহায়ণ মাসে (মধ্য-নভেম্বর থেকে মধ্য- ডিসেম্বর) চাষ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। দেশেও উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলে তাপমাত্রা ১৫* সে এর নিচে হলে ১০-১২ দিনপরে বীজ বপন করা উচিৎ। খরিফ-১ মৌসুমে অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ (মধ্য-এপ্রিল থেকে মধ্য-মে) মাসেও এর চাষ করা যায়।

বপন পদ্ধতি ও বীজের হার
সূর্যমুখীর বীজ সারিতে বুনতে হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ সেমি এবং সারিতে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২৫ সেমি রাখতে হয়। এভাবে বীজ বপন করলে হেক্টরপ্রতি ৮-১০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। বারি সূর্যমুখী-২এর জন্য হেক্টরপ্রতি ১২-১৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।

সারের পরিমাণ
সূর্যমুখীতে নিম্নরূপ পরিমাণে সার ব্যবহার করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।

সারের নাম সারের পরিমাণ/হেক্টর
ইউরিয়া         ১৮০-২০০কেজি
টিএসপি ১৫০-২০০ কেজি
এমপি         ১২০-১৫০কেজি
জিপসাম ১২০-১৭০ কেজি
জিংক সালফেট          ৮-১০কেজি
বোরাক্স/বরিক এসিড ১০-১২ কেজি
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ৮০-১০০ কেজি

[রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁ, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ ও রাজশাহী  এলাকার জন্য প্রয়োজন।]

বারি সূর্যমুখী-২ চাষের জন্য নিমেণ বর্ণিত হারে সার প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।


সারের নাম বিঘাপ্রতি  (কেজি) একরপ্রতি কেজি         হেক্টরপ্রতি কেজি
ইউরিয়া          ২৫-২৭ ৭৫-৮০০ ১৮০-২০০
টিএসপি  ২৩-২৫ ৬৮-৭২         ১৬০-১৮০
এমপি          ২০-২৫ ৬৩-৬৭         ১৫০-১৭০
জিপসাম  ২০-২৫ ৬৩-৬৭         ১৫০-১৭০
জিংক সালফেট          ১.৩৫         ৪          ৮-১০
বরিক এসিড  ১.৩৫         ৪          ১০-১২
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট* ১০.৫-১৩.৫ ৩২.৫-৪০.৫ ৮০-১০০
গোবর         ১.১-১.৩         ৩.২-৪.০ ৮-১০

[রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ ও রাজশাহী অঞ্চলের জন্য প্রয়োজন।]

সার প্রয়োগ পদ্ধতি
ইউরিয়া সারের অর্ধেক এবং বাকি সব সার শেষ চাষের সময় জমিতে ছিটিয়ে  মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ২ ভাগ করে প্রথম ভাগ চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর এবং দ্বিতীয় ভাগ ৪০ দিন পর বা ফুল ফোটার পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে।

বীজ শোধন
মাটি ও বীজ থেকে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের জন্য বীজ শোধন একান্ত প্রয়োজন। বীজ শোধনের ফলে প্রধানত বীজ বাহিত রোগ দমন হয়। ফলে জমিতে আশানুরূপ গাছের সংখ্যা পাওয়া যায় এবং ফলন ভাল হয়। ভিটাভেক্স-২০০ ছত্রাক নিবারক দ্বারা বীজ শোধন করা হয়। প্রতি কেজি সূর্যমুখী বীজের জন্য মাত্র ৩ তিন গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০ প্রয়োজন। একটি বড় প্লাস্টিকের ঢাকনাযুক্ত পাত্রে সূর্যমুখীর বীজ নিয়ে পরিমাণমত ঔষধ মিশিয়ে পাত্রের মুখ বন্ধ করে ভালভাবে ঝাঁকিয়ে ১ দিন রেখে দেবার পর বীজ জমিতে বপন করতে হবে।

অন্যান্য পরিচর্যা

সূর্যমুখীর পাতা ঝলসানো রোগ দমন
আমাদের দেশে সূর্যমুখীর রোগের মধ্যে পাতা ঝলসানো রোগটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অলটারনারিয়া হেলিয়ান্থি নামক ছত্রাকের আক্রমণে সূর্যমুখীর এ রোগটি হয়ে থাকে। প্রথম পাতায় ধূসর বা গাঢ় বাদামি বর্ণের অসম আকৃতির দাগ পড়ে। পরে দাগ মিশে গিয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে । অবশেষে সম্পূর্ণ পাতা ঝলসে যায়।

প্রতিকার
১. রোগ সহনশীল কিরণী জাত চাষ করতে হবে।
২. রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে রোভরাল-৫০ ডবিস্নউ পি (২% হারে) পানির সাথে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার জমিতে প্রয়োগ করলে রোগের প্রকোপ কমে যায়।
৩. ফসল কাটার পর গাছের পরিত্যক্ত অংশ নষ্ট করলে বা পুড়ে ফেললে এ রোগের উৎস নষ্ট হয়ে যায়।

সূর্যমুখীর শিকড় পচা রোগ দমন
সূর্যমুখীর সাধারণত স্কেলেরোশিয়াম রলফসি নামক ছত্রাকের কারণে এ রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত গাছের গোড়া সাদা তুলার মত ছত্রাকের মাইসেলিয়াম এভং গোলাকার দানার মত স্কেলেরোশিয়াম দেখা যায়। প্রথমে গাছ কিছুটা নেতিয়ে পড়ে। কয়েক দিনের মধ্যে সমসত্ম গাছ ঢলে পড়ে এবং শুকিয়ে মারা যায়।

প্রতিকার
১. ভিটাভেক্স-২০০ এর সাহায্যে মাটি শোধনের মাধ্যমে এ রোগের বিসত্মার রোধ করা যায়।
২. সাধারণত জমি পানি সিক্ত থাকলে এ ছত্রাক বাঁচতে পারে না। সুতরাং রোগ আক্রমণের পর জমিতে পস্নাবন সেচ দিয়ে প্রকোপ কমানো যায়।

৩. পর্যায়ক্রমিক ভাবে ফসলের চাষ করলে উপযুক্ত পোষক গাছের অভাবে পূর্ববর্তী আক্রমণকারী রোগের বিসত্মার রোধ করা যায়।

ফসল কাটা ও শুকানো
সুর্যমুখী বপনের ৬৫-৭০ দিন পরে ফুলের বীজ পুষ্ট হওয়া শুরম্ন হয়। এ সময় টিয়া পাখির উপদ্রব শুরু হয়। খুব ভোরে এবং সন্ধ্যার পূর্বে পাখীর আক্রমণ বেশি হয়। বীজ পুষ্ট হওয়া থেকে শুরু করে ফসল কাটা পর্যন্ত জমিতে সকাল বিকাল পাহারার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। জমির মাঝখানের চেয়ে চারি ধারে পাখির আক্রমণ বেশি হয়। বাঁশের সাহায্যে দূর থেকে টেনে শব্দ করলে জমিতে পাখি বসতে পারে না। বিচ্ছিন্ন জায়গায়, স্বপস্ন খন্ড জমিতে সূর্যমুখীর চাষ করলে পাখীর উপদ্রব বেশি হয়। এক সংগে বেশি এলাকায় সূর্যমুখীর চাষ করলে ফসলের ক্ষতি আনুপাতিক হারে  কম হয়। সূর্যমুখী কাটার সময় হলে গাছের পাতা হলুদ হয়ে আসে এবং পুস্পসত্মবক তক(মাথা) সহ গাছগুলো তনুয়ে পড়ে। বীঝগুলো কারো রং এবং দানাগুলো পুষ্ট ও শক্ত হয়। মৌসুম অনুসারে ফসল পরিপক্ক হতে ৯০-১০০ দিন সময় লাগে। সঠিকভাবে সূর্যমুখীর চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ১৫০০-১৮০০ কেজি বা প্রতি একরে ১৬-২০ মণ বীজ উৎপাদন করা সম্ভব।

গাছ থেকে পুস্পস্তবক সংগ্রহ করে রোদে ২-১ দিন ছড়িয়ে দিতে হবে। এসময় মাথাগুলো নরম হয়ে যায় ফলে শক্ত বাঁশের বা কাঠোর লাঠি দিয়ে সূর্যমুখীর মাথার পিছনে আঘাত করলে বেশির ভাগ বীজ ঝরে পড়ে। অবশিষ্ট বীজ হাত দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে হয়। বীজ ভালভাবে ছাড়িয়ে ৪/৫ দিন রোদে শুকানো উচিত। বীজ ছাড়ানোর পর মাথাগুলো গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ফসল কর্তণের পর সূর্যমুখীর গাছ ও পুস্পস্তবক জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

বীজ সংরক্ষণ বা গুদামজাতকরণ
সূর্যমুখী বীজ পরের মৌসুমে লাগানোর  জন্য গুদামজাত করা প্রয়োজন হয়। বীজে পানির পরিমাণ, সংরক্ষণকাল ও বাতাসের আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রা বিশেষভাবে অংকুরোদগম ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। বীজ সংরক্ষণের  পূর্বে  অপরিপক্ক এবং ভাংগা বীজ বেছে ফেলতে হবে। মোটা পলিথিন ব্যাগ বা কেরোসিন টিন বা টিনের ড্রাম বীজ সংরক্ষণের জন্য উত্তম। আর্দ্রতা এবং পোকার আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য পাত্রের মুখ ভালভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। বীজসহদ সকল সংরক্ষিত পাত্রগুলো একটি শুকানো এবং পরিস্কার ঘরে রাখতে হবে যেখানে বীজ পোকা-মাকড় বা ঈঁদুর দ্বারা আক্রামত্ম হবে না। ভেতরে পলিথিন দিয়ে চটের বসত্মায় ভালভাবে শুকানো বীজ প্রতি ৩০ কেজির জন্য ২৫০ গ্রাম ক্যালসিয়অম ক্লোরাইডসহ সংরক্ষণ করলে ৭-৮ মাস পরেও বীজের শতকরা ৮০ ভাগ অংকুরোদগম ক্ষমতা বজায় থাকে। এ সকল পাত্র মাটির সংস্পর্শে রাখা যাবে না। বর্ষাকালে এক থেকে দু’বার বীজ পুনরায় রোদে শুকিয়ে নেয়া ভাল।
তৈল নিষ্কাশন

ঘানিতে ২৫% এক্সপেলারে ৩০-৩৫% তেল নিঃষ্কাশন সম্ভব।
Previous Post Next Post